বাংলাদেশ যেন আগের শ্রীলঙ্কা

উপুল থারাঙ্গা আউট হতেই শ্রীলঙ্কা ৩ উইকেটে ৩১। ভেঙে গেল ইনিংসের কোমর। মিরাজের বোলিংয়ে দিনেশ চান্ডিমাল ক্যাচ সৌম্যর হাতে। শ্রীলঙ্কা ৫ উইকেটে ১২১। তার মানে মেরুদণ্ডও গেল। এই ভাঙাচোরা শরীরে ৩২৫ রানের দিকে ছুটে চলা যায় না। শেষ দিকে সাচিথ পাথিরানার সঙ্গে জুটি বেঁধে থিসারা পেরেরা কিছু শট খেলেছেন। তবে তা আসলে সান্ত্বনা। শ্রীলঙ্কা শেষ পর্যন্ত ৪৫.১ ওভারে অলআউট ২৩৪ রানে। ৯০ রানে হার। পরশু রণগিরি ডাম্বুলা স্টেডিয়াম শ্রীলঙ্কার যেমন পরাজয় দেখল, এমনভাবে আগে শ্রীলঙ্কার কাছে হারত বাংলাদেশ। পাশার দান তাহলে উল্টে যেতে শুরু করল?


পাশা খেলায় ভাগ্য থাকে। ক্রিকেটেও ভাগ্যের ছোঁয়া লাগে, তবে অতি সামান্য। দুটি সমান শক্তির দলের মধ্যে ভাগ্য একটা প্রভাবক। কিন্তু এখানে তো অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। প্রথম ওয়ানডের বাংলাদেশ দলের সব খেলোয়াড়ের মিলিত ওয়ানডে সংখ্যা ছিল ৮৯০। শ্রীলঙ্কার ছিল ৫৭৬! মাশরাফি, সাকিব, মুশফিক, তামিম ও মাহমুদউল্লাহ মিলেই তো খেলেছেন ৭৯৬টি ওয়ানডে। অনেকেই বলতে পারেন, এই জয়টা তো ছিল অবধারিত। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই কি অভিজ্ঞতার ব্যবধান বড় হয়ে ওঠে? বুঝতে হবে শ্রীলঙ্কা নামটির ভারও কম নয়। তার ওপর এই দলটিতে এমনও কয়েকজন খেলোয়াড় আছেন, যাঁরা একাই ম্যাচ বের করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। যেমন থারাঙ্গা, চান্ডিমাল, কুশল মেন্ডিস, থিসারা পেরেরা। আবার এটাও মনে রাখা উচিত, শ্রীলঙ্কা খেলছে ঘরের মাঠে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা দিবসের আগের রাতে প্রায় শতভাগ নিখুঁত পরিকল্পিত ম্যাচ খেলেই জিতেছে বড় ব্যবধানে। ক্যারিয়ারের অষ্টম ওয়ানডে সেঞ্চুরি করে ম্যাচসেরা তামিম ম্যাচ শেষে বলেছেন, ‘আমরা যেভাবে খেলতে চেয়েছি, সেভাবেই সবকিছু হয়েছে। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং সবকিছুই হয়েছে দুর্দান্ত।’
ডাম্বুলায় শনিবার রাতে বাংলাদেশ যেন ছিল আগের শ্রীলঙ্কা, আর শ্রীলঙ্কা আগের বাংলাদেশ। এই যে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া, এটা কীভাবে সম্ভব হলো? এই জয়ের রহস্য কি শুধু ওপরের ওই নিরেট বিশ্লেষণ? সাকিব আল হাসান অত গভীরে গিয়ে ভাবেননি, ভাবেনও না। কাল দুপুরে টিম হোটেলের রেস্তোরাঁয় বসে লাঞ্চ করছিলেন। বাংলাদেশের অলরাউন্ডারের কাছে জানতে চাইলে খানিক ভাবলেন। ভেবে ভেবে অবশেষে একটা কারণ খুঁজে পেলেন, ‘আসলে আমরা ভালো খেলেছি।’ তামিমের সঙ্গে এই প্রথম ওয়ানডেতে শতরানের জুটি হলো আপনার, এই জুটির নিশ্চয়ই ভূমিকা আছে? সাকিব তথ্যটা যেন প্রথম জানলেন, ‘তাই নাকি! হবে হয়তো। আসলে ওর সঙ্গে বেশি ব্যাট করার সুযোগ পাই না তো। ও ওপেনার, আমি নামি পাঁচে।’ জয় দিয়ে সিরিজ শুরু, নিশ্চয়ই দারুণ একটা অনুভূতি হচ্ছে আপনার বা দলের? সাকিব মৃদু হাসেন, ‘বলতে পারেন। আসলে ভালো খেললেই আমার ভালো লাগে।’
জয় দিয়ে সিরিজ শুরু, এখন তো সিরিজ জয়টা খুবই সম্ভব? মুখে ডিমের ওমলেটের এক টুকরো চালান করে দিলেন, মোবাইলে লিওনেল মেসির একটি পুরোনো ফুটবল ম্যাচের ভিডিও চালিয়ে দিলেন, খুব আস্তে কথা বেরোল তাঁর মুখ থেকে, ‘ভালো খেললে সম্ভব।’
প্রথম ম্যাচের দুর্দান্ত বাংলাদেশকে দেখে ডাম্বুলাবাসী অবশ্য তাদের গলাতেই সিরিজ জয়ের মালা তুলে দিয়েছে। তুলে তো দেয়নি, দিতে চাইছে আর কি! এ চাওয়ার পেছনে আছে বাস্তবতা, অনেক মানসিক ক্ষরণ। হোটেলের কর্মী থেকে শুরু করে, অটো ড্রাইভার বা দোকানি প্রতিবেদকের গলায় অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দেখে মুখে বলছেন একই কথা, ‘বাংলাদেশ দুর্দান্ত দল হয়ে উঠেছে। ওদের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার পেরে ওঠা কঠিন।’
কলম্বোর পি সারা ওভালে টেস্ট হারের পর শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে চালু ইংরেজি দৈনিক দ্য আইল্যান্ড টেস্ট ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কার শোকগাথা লিখে ফেলেছে। যেভাবে জন্ম হয়েছে অ্যাশেজের, ঠিক একই আদলে। এ ম্যাচ হারের পর পত্রিকাটি লিখেছে, শ্রীলঙ্কা দল যেন এক ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী। যার কোনো চিকিৎসা নেই, ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়াই তার নিয়তি।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একেকটি জয় এখন শ্রীলঙ্কানদের বুকে রক্ত ঝরায়। কিন্তু বাংলাদেশ কি এই জয়ে ঠিক ততটা উচ্ছ্বসিত হয়? জয়ের উদ্যাপন কেমন হলো, জানতে চাইলে সাকিব বলেন, ‘কই, সে রকম তো কিছু দেখলাম না!’ ড্রেসিংরুমে ‘আমরা করব জয়’ গানটি গাওয়া হয়নি? ‘হয়েছে মনে হয়’—উত্তর সাকিবের।
মিরাজের কাছে যা জানা গেল, তাতে ড্রেসিংরুমে একটু উদ্যাপন হয়েছে। তামিমের ১০ হাজার রান পূর্তিতেই অবশ্য আনন্দ হয়েছে বেশি।
হোটেলে কাল খুব নির্ভার লাগছিল দলকে। অনুশীলন ছিল না। ছুটির আলস্য ছিল সবার মধ্যে। মোসাদ্দেক-নুরুলসহ আরও কয়েকজনকে পুলে সাঁতার কাটতে দেখা গেল। কিন্তু কেমন আনন্দ হলো, এটাও তাঁরা বলতে পারছেন না।
মিরাজের কথাই হয়তো ঠিক, ‘সিরিজ তো এখনো শেষ হয়নি। আগেই সব উদ্যাপন করে ফেললে শেষে কী করব!’ মানে সিরিজ জিতেই উদ্যাপন করতে চায় বাংলাদেশ দল। এ এক নতুন বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ দলের ঠিকানা আলিয়া রিসোর্ট। দু-একজন সাংবাদিক ভুল করে বলে ফেলছেন, আলিয়া ভাট রিসোর্ট। না, বলিউডের নায়িকার সঙ্গে এই রিসোর্টের কোনো সংযোগ নেই। রিসোর্টের এক কর্মী বললেন, সিংহলিজ ভাষায় আলিয়া অর্থ বন্য হাতি। না, বন্য হাতির সঙ্গে মেলাবেন না। তবে বাংলাদেশ দলকে মনে হলো ওয়ানডে সিরিজ জয়ের অদম্য আকাঙ্ক্ষায় তারা যূথবদ্ধ। আগামীকালই কি সিরিজ জয়ের ম্যাচ?

No comments

Powered by Blogger.